বিডি ক্লিনের স্বপ্ন পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ অনলাইন ডেস্ক অনলাইন ডেস্ক প্রকাশিত: ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৯ স্টাফ রিপোর্টার : ব্যক্তি-উদ্যোগে শুরু হলেও দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে ‘বিডি ক্লিন’। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির মূল শক্তি শিক্ষার্থীরা। এর উদ্যোক্তা ফরিদ উদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করে সেই গল্প জানাগেছে। ২৮ মে ২০১৬। সিটি করপোরেশন শহরের রাস্তাগুলোয় সদ্যই ডাস্টবিন দিয়েছে। একটা ছবি ভাইরাল হলো তখন, ময়লাগুলো ডাস্টবিনের চারপাশে পড়ে আছে আর ডাস্টবিনটা ফাঁকা। চারুকলার প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফরিদ উদ্দিনের মনে হলো, এই ডাস্টবিনে ময়লা না ফেলাটা আসলে মানসিকতার সমস্যা। মানুষ শেখেনি এখনো ডাস্টবিনের ব্যবহার। সচেতনতা আসেনি মানুষের। তাই ঠিক করলেন, এমন কাজ করবেন, যেন সাধারণ মানুষের ভেতর পরিচ্ছন্নতার মানসিকতা তৈরি হয়। ভাবতে লাগলেন কী করবেন। জুনের ২ তারিখ ছিল বৃহস্পতিবার। এর আগে নিজের পরিচিত যাঁরা, তাঁর ডাকে আসবেন—এমন কজনের কাছে ফেসবুক বা ফোন মারফত সময় চাইলেন। সেই রাতে ২৪ জন জড়ো হলেন। এঁদের কেউ স্কুল শিক্ষার্থী, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের, কেউ হয়তো পড়াশোনা শেষ করে সদ্যই কর্মজীবনে ঢুকেছেন। সবাই এলেন। আড্ডা ও পরিচিতি হলো। একটু রাত হলে, খাওয়াদাওয়া শেষে ফরিদ সবাইকে একটা টি-শার্ট, মাস্ক, পলিথিন আর ঝাড়ু হাতে দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য জানালেন। বললেন, ‘আমরা চাই নিজেদের মধ্য থেকেই পরিচ্ছন্নতার যাত্রা শুরু করতে। তাই চারুকলা থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত আজ সারা রাত পরিষ্কার করব।’ কাজ শুরু হলো ঠিক রাত ১২টায়। সবাই বেশ উৎসাহী হয়ে কাজে লেগে পড়লেন। ময়লাগুলো প্যাকেটে করে, নয়তো কোথাও স্তূপ করে রেখে দিয়েছিলেন সেবার, যেন সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি এসে নিয়ে যেতে পারে। সকাল ৬টায় শেষ হলো কাজ। সবাই মিলে ছবি তুললেন। পরের দিন ‘ঢাকা ক্লিন’ নামে একটা ফেসবুক পেজ খুলে সেসব ছবি আপলোড করে জানান দিলেন নিজেদের। জানালেন, ‘আমরা এই কাজ করেছি। এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে আমরা একই কাজ করব। চাইলে আপনারাও অংশ নিতে পারেন।’ একই সঙ্গে পেজ থেকে পরের সপ্তাহের পরিচ্ছন্নতার জন্য ইভেন্ট খুলে ফেললেন। এবার পরিষ্কার করবেন সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত। তার পরের সপ্তাহে ফার্মগেট থেকে বিজয় সরণি। এর মধ্যে নারীরা কাজ করতে চাইলে রাতের সময়টা পাল্টে শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলো সময়। চতুর্থ সপ্তাহের ইভেন্টে এলো ৮২ জন। এবার টার্গেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের মানুষ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাজে ছিল ৩০০ জন লোক। এই কাজের ব্যাপ্তি এবার ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে গেল। অনেক জায়গা থেকেই লোকজন এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতে চাইল। ২০১৬ সালের আগস্টেই বরিশালে একদল লোক কাজ শুরু করল। তারপর সেপ্টেম্বরে ময়মনসিংহ, নভেম্বরে খুলনায়। এক বছরের মাথায় ছয়টি বিভাগীয় শহর এবং বেশ কয়েকটি জেলা শহরেও শুরু হলো পরিচ্ছন্নতা অভিযান। প্রথম বার্ষিকীতে এই ‘ঢাকা ক্লিন’ তাই ‘বিডি ক্লিনে’ রূপান্তরিত হলো। ফরিদ বলছিলেন, “আমরা বেশ কয়েকটি স্লোগান, ট্যাগলাইন এবং কিছু বাক্য মেনে চলি। আমাদের ট্যাগলাইন ‘পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের স্বপ্ন’ স্লোগান ‘পরিচ্ছন্নতা শুরু হোক আমাদের থেকেই’। আর আমাদের প্রত্যাশা ‘শুরুটা এখানেই, শেষ করার দায়িত্ব আপনাদের’। তা ছাড়া আরো একটা লাইন আমরা বেশ ব্যবহার করি, ‘এ শহর আমার, এ দেশ আমার, পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বও আমার’। ফরিদ কাজের পদ্ধতি নিয়ে বলছিলেন, ‘আমরা কাউকে জোর করি না। কাউকে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে চাই না; বরং নিজেরা কাজ করে দেখাই। তাতে যদি কেউ নিজ থেকে আগ্রহী হয়ে আমাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়, তাকে আমরা বরণ করে নিই। আমাদের সদস্যদের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লালন করতে হয়। ১. লোভ ও হিংসা ত্যাগ করা; ২. পেশা-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার প্রতি সম্মানবোধ তৈরি করা; ৩. কাউকে দোষারোপ না করা; ৪. আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং ৫. যত্রতত্র ময়লা ফেলার অভ্যাস বর্জন করা। মূল ব্যাপার হচ্ছে, আমরা ‘চেষ্টা’ ও ‘পরিবর্তন’ এই দুটো শব্দকে বাদ দিয়েছি; বরং ব্যবহার করছি ‘চর্চা’ ও ‘রূপান্তর’। কারণ চেষ্টা একটা ঘোলাটে শব্দ; এটা দিয়ে অনেক কিছু থেকেই ছুটে আসা যায়। আমরা তাই চর্চায় বিশ্বাসী। আর পরিবর্তন হলে সেটারও পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে! আমরা তাই ক্রমে রুপান্তরিত হয়ে যেতে চাই ভালো মানুষে।” ফরিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গত বছরের জুন মাস থেকে ‘বিডি ক্লিন’ জেলাভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করেছে। এখন দেশের ৫৫টি জেলায় সমান গতিতে চলছে তাদের কাজ। এ বছরের জুন মাস থেকে শুরু হয়েছে উপজেলা পর্যায়ে। পুরো সংগঠনের সমন্বয়ক ফরিদ উদ্দিন। এ ছাড়া বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক রয়েছেন। ‘বিডি ক্লিনে’র মূল কাজ পরিচ্ছন্নতা। দেশব্যাপী যেখানেই ‘বিডি ক্লিন’ রয়েছে, সেখানেই নিয়মিতভাবে চলছে সাপ্তাহিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু কাজ করেছে সংগঠনটি। ২০১৭ সালে সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিচ্ছন্নতার বোধ জাগানোর জন্য রোড শো করেছে এটি। সেখানে অংশগ্রহণকারীরা প্রতীকীভাবে নিজের চারপাশ পরিচ্ছন্ন করার তাগিদ দিয়েছে মানুষকে। সে বছরেরই নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ সপ্তাহব্যাপী পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালিয়েছে ‘বিডি ক্লিন’। ক্যাম্পাসকে ১২১ ভাগ করে ১৭০০ সদস্যের একটা দল করেছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এরই অংশ হিসেবে গত বছরের ২৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উপাচার্যের উপস্থিতিতে ‘পরিচ্ছন্ন বিশ্ববিদ্যালয়’ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া এই সংগঠন দেশব্যাপী আয়োজন করেছে ‘ক্লিন ক্যাম্পাস, গ্রিন ক্যাম্পাস’ প্রতিযোগিতা। ১৪০০ ক্যাম্পাসের অংশগ্রহণে তাতে প্রতিটি ক্যাম্পাসের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১০১ সদস্যের একটা টিম করা হয়েছে। তাঁদের দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন টাস্ক। এর মধ্যে পরিচ্ছন্নকরণ ও সবুজায়ন একটা বড় টাস্ক। প্রতিযোগিতাটিতে জেলা পর্যায়ের সেরা ক্যাম্পাসকে ‘বেস্ট ক্লিন ক্যাম্পাস’ এবং বাকি দুটিকে ‘বেটার’ ও ‘গুড’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। জানা গেল, জেলা পর্যায়ের সেরা ক্যাম্পাসগুলো নিয়ে আগামী নভেম্বরে আরেকটি আয়োজন করা হবে। সবার অংশগ্রহণে সেদিন সেরা পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাসকে ঘোষণা করা হবে ‘বেস্ট ক্লিন ক্যাম্পাস’। গত শুক্রবার ছিল সংগঠনটির একটি নতুন আয়োজন। বিভিন্ন জেলার টিমগুলো নিজ জেলার একটি আবর্জনাযুক্ত জায়গা বেছে নিয়ে সেটিকে পরিষ্কার করে একই জায়গার দুটো তুলনামূলক ছবি দিয়েছেন। ২২টি জেলার অংশগ্রহণকারীরা এখানে অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে রেল স্টেশন, পানি প্রবাহের নালাসহ বিভিন্ন জায়গা ছিল। ফরিদ বলছিলেন, ‘আমাদের সদস্যসংখ্যা এখন ১৮ হাজারের মতো। এদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। এ ছাড়া রয়েছেন কিছু চাকরিজীবী ও খুদে ব্যবসায়ী। তাঁরা সবাই সক্রিয়। নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের এই পুরো কার্যক্রমের ব্যয় বহন করা হয় সদস্যদের টাকা দিয়ে। টাকার অঙ্ক আমরা নির্ধারণ করে দিই না; বরং যে যাঁর সামর্থ্যমতো টাকা দেন। এমনকি আমাদের টি-শার্ট, যেটিকে আমরা ইউনিফর্মের মর্যাদা দিই, সেটাও কিনে নিতে হয় আমাদের কাছ থেকে। এভাবেও টাকা সংগ্রহ হয়। নতুন সদস্যকে আমরা চার সপ্তাহ নজরে রাখি। ঠিকঠাক কাজে অংশ নিলেই তাঁকে টি-শার্ট কেনার অনুমতি দেওয়া হয়।’ সুনাগরিক গড়ার কাজে ভালোভাবেই এগোচ্ছে ‘বিডি ক্লিন’। বহিরাঙ্গের পরিচ্ছন্নতার মতো ভেতরকার পরিচ্ছন্নতাকেও সমানতালে গুরুত্ব দেয় সংগঠনটি। ফরিদ তাই জানালেন, ‘এই সংগঠনের সদস্যদের বিনয়ী হওয়া, সুনাগরিক হওয়া একান্ত জরুরি। যেদিন আমাদের পাঁচ লাখ সক্রিয় সদস্য হবে, সেদিন দেশের কোথাও কোনো যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটবে না—এমনটাই বিশ্বাস আমাদের। আমরা চাই, সুনাগরিকের মানদণ্ডে বাংলাদেশ একটি উদাহরণ হয়ে উঠুক।’ Related posts:পুলিশে বড় পদোন্নতি, অতিরিক্ত ডিআইজি হলেন ১৫২ কর্মকর্তাট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কুশল বিনিময়প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ Post Views: ১৫২ SHARES জাতীয় বিষয়: