ঠাকুরগাঁওয়ে আমনেও মলিন কৃষকের মুখ

প্রকাশিত: ১:১৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২১, ২০১৯

অনলাইন ডেস্ক : সূর্যের আলোয় কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে আসে ভোরের প্রকৃতি। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে দিগন্তবিস্তৃত আমন খেত। সোনারোদে মাঠের সোনালি ধানের শিষ ঝিকিয়ে উঠেছে। আর পাকা ধানের ম-ম গন্ধে মাতোয়ারা কৃষকের চোখেমুখে ফুটে ওঠে খুশির ঝিলিক। কিন্তু হাটবাজারে ওই ধান বিক্রি করতে গিয়ে দাম না পেয়ে কৃষকের মুখ বিষাদে ভরে ওঠে।

ঠাকুরগাঁওয়ে সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান কৃষকের ঘরে ওঠে। কিন্তু জেলায় এবার অনেক কৃষক আগাম জাতের আমন ধান আবাদ করেছেন। এরই মধ্যে সেসব খেতের ধান কাটা শুরু হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১ লাখ ৪৯ হাজার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে চলতি মৌসুমে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৫ হেক্টরে। এ বছর কৃষকেরা ১৮ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে আগাম আমন হাইব্রিড ও ৬ হাজার ২২৩ হেক্টরে উফশী জাতের ধান আবাদ করেছেন।

কৃষি বিভাগ প্রতি মৌসুমের ধান উৎপাদন খরচ ও বাজারদর বিশ্লেষণে করে। সেই বিশ্লেষণের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এক একরে আমন ধান উৎপাদন করতে খরচ (জমি চাষ, বীজ-চারা, সার, কীটনাশক, শ্রমিকের মজুরি) লাগে ৩১ হাজার ৯৬১ টাকা। আর খড় বিক্রি করে পাওয়া যাবে চার হাজার টাকা। মোট উৎপাদন খরচের থেকে খড় বিক্রির টাকা বাদ দিলে নিট উৎপাদন খরচ পড়ে ২৭ হাজার ৯৬১ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি ধান আনুষঙ্গিক খরচসহ উৎপাদন করতে ব্যয় ১২ টাকা ৯৪ পয়সা হিসাবে প্রতি মণ (৪০ কেজিতে) ধানের দাম হয় ৫১৮ টাকা।

গত বুধবার থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত সদর উপজেলার খোঁচাবাড়ি, রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ এবং বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লাহিড়ী, মাদারগঞ্জ হাটে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমন মৌসুম বৃষ্টিনির্ভর। কিন্তু এবার তেমন বৃষ্টি হয়নি। এ কারণে কৃষকদের সেচযন্ত্র ব্যবহার করে খেতে সেচ দিতে হয়েছে। এতে আমন উৎপাদনে তাঁদের বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। হাটগুলোতে প্রতি মণ ভেজা আমন ধান ৩৬০ থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ সরকারি হিসাবে প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৫১৮ টাকা।

গতকাল সদর উপজেলার গড়েয়া, গৌরীপুর ও উনত্রিশ মাইল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাঠে মাঠে পাকা ধান। সেসব ধান কেটে ঘরে তুলতে মাঠে নেমেছেন কিষান-কিষানিরা। কাটার পর কেউ কেউ ধানের বোঝা মাথায় তুলে নিয়ে যাচ্ছেন মাড়াইয়ের জায়গায়। মাড়াই শেষে তাঁরা ধান বস্তায় ভরে রাখছেন।

সে সময় উনত্রিশ মাইল এলাকার কৃষক জীতেন রায়ের (৫৬) সঙ্গে কথা হয়। কথা প্রসঙ্গে ধানের ফলন তো ভালোই হয়েছে, এমন কথা শুনে তিনি এই প্রতিবেদকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। পরে বলতে লাগলেন, ‘তোমরা তো ধানের ভোলো ফলনটাই দেখিলেন। বাজারত যে ধানের দাম নাই, সেখান দেখিলেননি।’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক কৃষক রইসউদ্দিন (৪৯) বলেন, ‘এবার ধানের ফলন দেখে মনে কী যে আনন্দ লেগেছিল, তা বোঝাতে পরব না। কিন্তু ধান মাড়াইয়ের পর হাটে বিক্রি করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। এক মণ ধান আবাদ করতে খরচ লাগে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। আর বর্তমানে বাজারে এক মণ ধান বিক্রি করছি ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকায়। এই দরে ধান বিক্রি করে তো আমাদের উৎপাদন খরচই উঠছে না।’

একই উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের কৃষক আবু হোসেন (৬১) বলেন, গত মৌসুমে কৃষক ধান আবাদ করে মূলধন পর্যন্ত তুলতে পারেননি। ধানে যে লোকসান হচ্ছে, তাতে আর ধান আবাদ করা সম্ভব নয়।

চলতি আমন মৌসুমে গড়েয়া গ্রামের কৃষক জগেশ্বর রায় (৬২) এক একর জমিতে ধান আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, ধান আবাদ করে গত বোরো মৌসুমে লোকসান হয়েছে। এবার এক মণ আমন ধান আবাদ করতে খরচ পড়েছে প্রায় ৫৫০ টাকা। আর তা বিক্রি করতে হচ্ছে ৩৬০ টাকায়। কৃষক ধানের দাম না পেলে বাঁচবে কীভাবে?

জানতে চাইলে সদর উপজেলার গৌরীপুর গ্রামের কৃষক হযরত আলী (৬৭) আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে ধান আবাদ করে ১০ হাজার টাকা লস (লোকসান)। আমরা কীভাবে আবাদ করিব। আবাদ করার তো কোনো বুদ্ধি নাই। এমন লস হইলে কেং করে আবাদ করিমো হামরা।’

তবে কৃষকের বক্তব্য মানতে নারাজ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আফতাব হোসেন। তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণে কৃষকের সেচ দিতে হয়নি। পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের জন্য অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়নি বলে কৃষকের আমন উৎপাদন খরচ কম হয়েছে। ফলে আমনের দাম না পেলেও কৃষকের পুষিয়ে যাচ্ছে।