মাহমুদ ফয়সাল‘র “ভেজা চোখ”

প্রকাশিত: ৮:৩১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯

(২য় অংশ)
শুক্র বার সকাল ৯.৩০ মিনিট। রানা আখতার সাহেবের থেকে টাকা নিয়ে সকাল সকাল বাজারে এসেছে। তার বোন তামান্না আসার আগে ব্যাগটা হাতে তুলে দিতে দিতে বলেছে ভাই আজ ভাল দেখে মাছ আনবা, সেদিনও মাছ আনছো একটু নরম হয়ে গেছে, আজ আর নরম মাছ কাটবো না। আর পারলে বড় দেখে কৈ মাছ এনো। রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে বেশ কয়েকবার রানার চোখে কৈ মাছের অবয়ব চোখে ভেসেছে। রানা বাজারের ভিতর দিয়ে হাটার সময় দু হাত দিয়ে জামাটা আটোসাটো করে হাটছে,নোংরা পানি যেনো জামাতে না লাগে।বেশি দরের কাছে না যাওয়াটাই তার ইচ্ছা। এটাতে বেশি টাকা খরচ হলে তরকারি কিনতে হিমশিম খেতে হবে।
কৈ মাছের কাছে যেতেই মাছওয়ালা না দেখার ভান করলো। না দেখার ভান করার কারন হলো সপ্তাহে দু বার হলেও সে এখানে আসে। প্রতি বারই দর কষাকষি শুরু করে।বিরক্তি করার প্রাক্কালে একসময়ে মাছ না কিনেই এসে যায়।দর কষাকষি ছাড়া কিইবা করবে? খরচ একটু কম করে সংসারের জন্য টাকা বাচিয়ে রাখে। তার বাবা বলেন আজকাল সবখানে যে দাম, সংসার চালাতে থেমে যেতে হয়।আজ তার ভাই ওটা চায় তো কাল আরেকটা, তামান্না তো কিছুদিন পর পর নতুন নতুন জিনিসের জন্য বায়না ধরে।সব খরচ করতে তার বাবার সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হয়, এটা সে বুঝে কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা তার এখনো হয়ে ওঠেনি। বাকিদের স্কুল খরচ,টিউশন ফি খাতা কলম হাবিজাবি আরো কত কি! গত সপ্তাহে এক কান্ড হয়ে বসলো, রাস্তার পাশে ড্রেনে হোচট খেয়ে পড়ে তামান্নার ছোটটা হাতে ভীষন ব্যাথা পেল। দেখতে দেখতে রক্ত বের হয়ে পড়ছে গড়গড়িয়ে। ধরাধরি করে পাশের ফার্মেসিতে নিয়ে যাওয়া হলো, সেলাই লাগলো ৫টা । সব খরচ সহ ফার্মেসির ডাক্তার ২৫৫০/- টাকার একটা হিসেব বুঝিয়ে দিল। এ রকম ছোট খাটো ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে রানাদের পরিবারে। এগুলো তারা নিতান্তই আপন ভাবে। বিষয়টা এমন হয়েছে যে এরকম দু একটা ঘটনা না ঘটলে মাসটাই শেষ হয়না। এতকিছুর মাঝেও রানার বাবা বেশ হাসি খুশিই থাকেন।
রানা ঃ কৈ মাছ কত?
মাছওয়ালাকে দুবার জিজ্ঞেস করার পরে বিরস মুখে তাকিয়ে বললো ৫৬০ টেহা কেজি।
রানা ঃ একটু বেশি হয়ে গেলো না?
মাছওয়ালা ঃ দাম বেশি না, আপনি বিরক্ত করতে আইছেন তো তাই বেশি মনে হইতেছে ।
রানা ঃ কি যে বলেন ভাই! বিরক্ত করতে কেনো আসবো? আপনি হইলেন আপনা লোক। আর কিছু কম বললে নিতে পারতাম।
মাছওয়ালার সাথে হেলপার ছোট ছেলেটা ড্যাব ড্যাব করে আখতার রানার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ভদ্র ছেলেটাকে প্রায় সবসময় দেখে এমন করতে।
পকেটের অবস্থা খুব বেশি ভালো না, কৈ মাছ মনে হয় আজ আর কেনা হবেনা।পিছনের দিকে ফিরে রানা সামনের দিকে এগুতে লাগলো। মাছওয়ালা পেছন থেকে কি যেনো বলছে, অস্পষ্ট কথাটা জানতে ইচ্ছে করছেনা।
পুঁটি মাছ, আলু, বেগুন, কাচামরিচ কিনে রওয়ানা দিলো। আজ কম দরে কাচা মরিচ পেয়েছিলো। তবে বোনের বারন থাকার কারনে আধা কেজির বেশি কিনতে পারলো না। বাসায় ফ্রিজ নাই বলে বেশি কিনতে বারন।আখতার সাহেব বেশ কয়েকবার ফ্রিজ আনতে গিয়েও ফিরে এসেছেন, একসাথে ৩৫ হাজার টাকা বের করা উনার জন্য বেশ কষ্টের।
বাজার থেকে হেটে যাবার সময় পেছন থেকে সাত্তার সাহেব সালাম দিলেন ‘স্লামালিকুম রানা, উঠো উঠো রিক্সাতে উঠো বাবা । রানা বললো না আঙ্কেল আপনি যান, আমার হাটতে ভালো লাগছে।সাত্তার সাহেব আর একবার বললেন রানা বাবা, উঠো, রানা না করলো আবার।
সাত্তার সাহেব এই রকম বিরক্ত প্রায় সময় করে থাকেন। ঐ যে ঐদিনও একবার বাজারে হঠাৎ দেখা ,বাজারে দেখেই বলতেছেন “ আওে বাবা রানা? ঐ যে রুই মাছ দেখা যায় আমি চাচ্ছিলাম বাবার জন্য এটা কিনে দিতে ” তোমার বাবা আমার বন্ধু মানুষ, অনেক সময় মন চায় কিছু কিনে দিতে,কিন্তু সময়ের বড় অভাব বুজলা?” রানা যথেষ্ট লজ্জা বোধ করলো, বাজারে ভিড়ের মাঝে হুড়হুড় করে একটা লোক তাকে কথা বলে যাচ্ছে, আর পাশে থেকে মাছওয়ালাটা কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে! এই পরিস্থিতিতে রানা রাগ দেখিয়েও দেখাতে পারলো না । তার বাবার বন্ধুকে কিছু দিবে ভাল কথা,তবে সেটা ডোল বাজিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিতে হয় কেন?? আর মাছের বিষয় এখানে আসবে কেন?ূবিরক্তিকর! বড্ড বিরক্তিকর।
বোনটা খুব শখ করে বলে দিছিলো কৈ মাছের কথা,টাকার অভাবে কেনা হয়নি। কি বলবে ভাবছে,একেটু আগে কি যেনো ভেবে রেখেছিলো তবে হেলপার ছেলেটার তাকানোর জন্য সেটাও ভুলতে হয়েছে। শীতের দিন ,রোদ ওঠেনি ভালো করে,তবুও কেনো জানি রানা ঘেমে গেছে।
১০/১২ মিনিট হাটার পর বাসায় উঠলো রানা। তামান্না বাজারের ব্যাগটা এগিয়ে নিয়ে গেলো। মুচকি হাসিতে তার মুখটা গোল হয়ে চোখ গুলো চিকচিক করছে। রানা জলচৌকির উপরে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস দিচ্ছে নিজের শরীরে। আখতার সাহেব হয়তো বন্ধের দিন পেয়ে এই সময়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ঘরের ভেতর থেকে তামান্না বলছে “ ভাইয়া কৈ মাছ আনলানা??
রানা ঃ না রে , বড় কৈ মাছ ওঠেনি বাজারে। ছোট মাছ খেলে ভাতের মত লাগবে , তাই আনিনি। কথাটা বলার সাথে সাথে রানার শরীররটা হিম শীতল হয়ে গেলো। হাত পাখার বাতাসটা বিরক্ত লাগছে, গলাটাও শুকিয়ে গেছে। তিনি বললেন ‘তামান্না একটু পানি আনবি? খাবো । খুব পিপাষা লেগেছে’। রানা ভাবছে ; এইতো বোনটা কাল অবদি কত ছোট ছিলো,আজ কত বড় হয়েছে।কাল পরের বাড়ি চলে যাবে। যেই মেয়েটা সামান্য চকলেটের জন্য কেদে ধুলায় গড়াগড়ি খেতো, সে আজ ঘর গুছাতে কত ব্যস্ত; বাড়ির কাজের দিকে কতইনা মনোযোগী। বাকি ছোটদের দেখে রাখে সে, দাত ব্রাশ করিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুম পাড়ানি নাগাদ সব কাজ সে একাই করে।
তামান্না ঃ ধরো ভাইয়া তোমার পানি।
রানা হঠাৎ কথা শুনে হচকিয়ে গেলেন। সে বললো ‘দে দে’।
পানির কলটা ছেড়ে দে, গোসল করবো,নামজে যেতে হবে। আজ জুমার নামাজ। আমাদের জন্য ঈদের নামাজের মতন।
তামান্না ঃ ভাইয়া , কৈ মাছের কথা তোমাকে এম্নিতেই বলেছিলাম, আরেকদিন কৈ মাছ এনো, আজ পুটি মাছ গুলো নতুন আলু দিয়ে শুকনা করে রাধবো ।
রানা কিছু না বলে গামছা ও লুঙ্গি হাতে নিয়ে চলে গেলো গোসলখানায়।
প্রায় ৩০ মিনিট পরে বের হলো তার মায়ের চেচামেচিতে।
রানার মা বলছে ‘ কি যে হয়েছে এই শীতের দিন কি কেউ এত পানি ঢালে?? আজ আবার ঠান্ডা লাগবে।
রানা ভুলেই গেছিলো শীতের দিনের কথা।
নামাজ শেষে বাড়ির উঠোনে রোদের দিকে পিঠ করে খেতে বসেছেন রানা আর আখতার সাহেব।খাবার খেতে খেতে রানা ভাবছে ফাষ্ট ফুড মানুষে কেন খায়?? তারা যদি জানতো আলু আর পুঁটি মাছ দিয়ে শুকনা করে রেধে খাওয়া কি যে মজা তবে ফাষ্ট ফুড খাওয়া ছেড়ে দিত কত আগেই!!
আজ খাবারের সময় আখতার সাহেব কোন কথা বলেনি,কথা বলেনি রানাও…
চলবে…