জামালপুরে পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত অনলাইন ডেস্ক অনলাইন ডেস্ক প্রকাশিত: ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৯, ২০২০ জামালপুর প্রতিনিধি ॥ ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে যমুনা এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সরিষাবাড়ি, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও মেলান্দহ, মাদারগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। প্লাবিত এলাকার জনসাধারণ তাদের গৃহ পালিত পশু গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগী এবং শুকনো খাবার নিয়ে উঁচু স্থান এবং আশ্রয় কেন্দ্রে উঠছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রোববার (২৮ জুন) রাত ৮টা পর্যন্ত উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ৫৩টি গ্রামের ১৫ হাজার ২২৪টি পরিবারের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী। তিনি আরও বলেন, জেলার ৪৬১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা নেয়ার জন্য ইঞ্জিন চালিত ১২টি নৌকা রাখা হয়েছে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি পরিমাপক (গেজ রিডার) আব্দুল মান্নান জানান, বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে আজ সকাল পর্যন্ত যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, গত চারদিন ধরে বন্যার পানি হুহু করে বাড়ছে। এদিকে দ্রুতগতিতে বন্যার পানি বৃদ্ধির কারণে নদীপাড়ের নিম্নাঞ্চলের ফসলি জমিতে, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে এবং প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ইসলামপুর উপজেলার সাপধরী ইউপির চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন জানান, “যমুনার চরে জেগে উঠা সাপধরী ইউনিয়নের নতুন চরাঞ্চল সমূহে আষাঢ় মাসেই অতিরিক্ত বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এতে প্রজাপতিচর, চরশিশুয়া, চরনন্দনেরপাড়া, আমতলী, কাশারীডোবাসহ এসব চরাঞ্চলের ৩ হাজার বাড়ি-ঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে”। চিনাডুলি ইউপির চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম জানান, “এ বছরের আগাম বন্যায় নিম্নাঅঞ্চল এলাকায় রাস্তাঘাট যাতায়াত বন্ধ এবং যমুনা চরাঞ্চল বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। নিম্নাঞ্চল এলাকায় বেশির ভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে এতে ৪ হাজার পরিবারের প্রায় ৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে”। ইসলামপুরের বেলগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক জানান, এ বছরের আগাম বন্যায় যমুনার বুকে জেগে ওঠা খোলাবাড়ী, বরুল, মন্নিয়া ও বেলগাছায় কৃষকের পাট ও ধান ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ইসলামপুর ইউএনও মোহাম্মদ মিজানুর রহমান শ্যামলী নিউজ ২৪ ডটকমকে জানান, বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সবাইকে নিয়ে বন্যা মোকাবিলায় কাজ করা হবে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এড. জামাল আব্দুন নাছের বাবুল জানান, যমুনায় খুব দ্রুত গতিতে পানি বাড়ছে। সেই সাথে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীর পানিও বাড়ছে। বন্যা মোকাবিলায় উপজেলা পরিষদ প্রস্তুত রয়েছে। জামালপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী জানান,“এরই মধ্যে ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জের বন্যার্ত এলাকায় ২০ মেক্ট্রিক টন জিআর চাল বিতরণ করা হয়েছে এবং ত্রাণ সামগ্রী হিসাবে ৩৫০ মেক্ট্রিক জিআর চাল, ৭ লাখ নগদ টাকা ও ২ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট চাহিদা চেয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে”। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সাইদ জানান, “যমুনায় দ্রুত গতিতে পানি বাড়ছে। সেই সাথে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীরও পানি বাড়ছে”। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এনামুল হাসান জানান, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের সমস্ত নিম্নাঞ্চলগুলো বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। আখ, পাটসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত মানুষদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অনেকে গবাদিপশু এবং পরিবার নিয়ে বিভিন্ন অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। দেওয়ানগঞ্জে বন্যার্তদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে হাইস্কুল ও বীর হল্কা স্কুল। বিকেলে উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ সোলায়মান হেসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা রাজিয়া ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার এনামুল হাসান আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন করে করোনা ভাইরাসের মরামারি থেকে রক্ষা পেতে আশ্রিতদের মাঝে হাত ধোয়ার সাবান ও মাস্ক বিতরণ করেন। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ বন্যার পানি প্রবেশ করায় অফিসিয়াল কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় আগামীকাল থেকে উপজেলার সরকারি গণগ্রন্থাগার থেকে অস্থায়ীভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম চলবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা রাজিয়া । ইসলামপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান টিটু জানান- উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ৩২টি গ্রামের ৭ হাজার ৮৭০টি পরিবারের প্রায় ৩১ হাজার ৪৮৫ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারিভাবে ১০৭টি আশ্রয়ন কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে ও পানিবন্দী মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ, শুকনো খাবার, ওষুধ সামগ্রী মজুদ রয়েছে। পাথর্শী ইউপি চেয়ারম্যান ইফতেখার আলম বাবুল জানান, শশারিয়াবাড়ি, পশ্চিম মোরাদাবাদ, পাথর্শী আংশিক, পশ্চিম মোজাআট, পশ্চিম হাড়িয়াবাড়ি, পশ্চিম গামারিয়া, খলিশাকুড়ি, পশ্চিম ঢেংগারগড়, জারুলতলা, বেড়েগাঁও, মহিষকুড়া গ্রামগুলো পানির নিচে তলিয়ে ২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ও মলমগঞ্জ-জারুলতলা বাজারের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকার কাচা-পাকা রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। সাতপোয়া ইউনিয়নের, ছাতারিয়া চুনিয়াপটল, আদ্রা, রৌহা, নান্দিনা, জামিরা ও সরিষাবাড়ি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগুলোর ফসলি জমিতে পাট, আষাঢ়ী ভুট্টা, তিল, বাদাম, আখসহ বিভিন্ন সবজির আবাদি জমিতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়াও পোগলদিঘা, আওনা, পিংনা, কামরাবাদ, ভাটারাসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আওনা, ঘুইঞ্চাচর, কুলপালচর, স্থল, উল্লাহ কুমারপাড়া, বিলচতল, বাড়উকান্দি, কুমারপাড়া, নলসন্ধ্যা, মিরকুটিয়া, কাজলগাঁও, দমোদরপুর, চর পোগলদিঘা, কালিপুর, শ্যামপুর, মালিপাড়া, বিন্নাফৈর, টাকুরিয়া, মানিক পোটল, গোবিন্দ পোটল, চর সরিষাবাড়ি, চর নান্দিনা, আদ্রা, ছাতারিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নিুাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে আওনা, ঘুইঞ্চা, কুলপালচরের শত শত একর তিল, বাদাম, পাটসহ আষাঢ়ী ভুট্টা ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘুইঞ্চা চরের বিটলের ৩ বিঘা পাকা ভুট্টা ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। একই গ্রামের ফজলুল হকের ৪ বিঘা, সাইফুলের ২ বিঘা, ওসমান, দুলাল, কামালসহ অনেকের ভুট্টা ক্ষেতে এখন পানি আর পানি। কুলপালচরের ইলিয়াস সরকার জানান, পাকা তিল পানিতে চোখের সামনে তলিয়ে গেলো। এ সভর ৮ বিঘা জমিতে তিল বুনে ছিলাম। আর এক সপ্তাহ পরে পানি আসলে কোনো ক্ষতি হতো না। একই কথা জানান, জাহিদ, খোকন, বেলাল, ইব্রাহিম, ফজল, বারেক, সরেয়ার, মনোয়ার, আনোয়ার, ছানোয়ারসহ শ শত কৃষক। লেবু মিয়া জানান, আগাম বন্যায় আমার ৩ বিঘা জমির পাট তলিয়ে গেছে। দ্রুত পানি বৃদ্ধির ফলে পুরো ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এতে কৃষকের যে পরিমাণ ক্ষতি হলো তা পুষিয়ে উঠা খুবই মুসকিল। এছাড়াও জামাল, সেজাব, দুদু, সালাম, কালাম, ঠান্ডু, বেলাল, রফিকসহ হাজার হাজার একর কৃষকের পাট ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বকশিগঞ্জে নতুন করে আরো ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে বকশীগঞ্জ উপজেলায় সাধুরপাড়া, মেরুরচর, নিলক্ষিয়া ও বগারচর ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এতে করে প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানি বৃদ্ধির ফলে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের বিলেরপাড়, উত্তর আচ্চাকান্দি, মদনের চর, কতুবের চর, চর গাজীরপাড়া গ্রাম প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নৌকা ব্যতিত এই গ্রামগুলোতে যাওয়া যাচ্ছে না। সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু জানান, দ্রুত গতিতে পানি বৃদ্ধির কারণে কৃষকের সবজি, মরিচ খেত, পাটখেত পানিতে ডুবে যাচ্ছে। দিশেহারা কৃষক পাট খেত অপরিপক্ক হওয়ার আগেই কেটে ফেলছেন। তিনি বন্যা কবলিত এলাকায় সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করার দাবি জানিয়েছেন। বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আ. স. ম. জামশেদ খোন্দকার জানান, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বন্যা মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা হবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আমিনুল ইসলাম জানান, জেলায় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ১৫৭৫ হেক্টর জমির পাট, ১৩০ হেক্টর আউশ ধান, ১৭৭ হেক্টর সবজি, ১৭ হেক্টর বীজতলা ও ২ হেক্টর জমির বাদাম। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আবু সাইদ জানিয়েছেন, পানি বাড়ছে দ্রুত গতিতে। আরো দুএকদিন একই গতিতে পানি বাড়বে। বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনে করছে মোকাবেলায় পানিউন্নয়ন বোর্ডের কর্মীরা প্রস্তুত রয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক শ্যামলী নিউজ ২৪ ডটকমকে বলেন, যমুনা নদীর পানি বাড়তে থাকায় বন্যার পূর্বাভাস পেয়েই জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা করা হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ ও প্রাণিসম্পদ নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা ও ত্রাণসহায়তাসহ সবধরনের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মাঠপর্যায়ের সকল কর্মকর্তাদেরকেও প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই কমিটি বাড়িতে পানি উঠায় জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেয়া বন্যার্তদের খোঁজ খবর নিতে উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। Related posts:আজ শ্রীবরদী হানাদারমুক্ত দিবসশেরপুরের জেলা প্রশাসকের সহায়তায় এবার ঢাবিতে ভর্তির সুযোগ পেলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রকসবায় বিএসএফের গুলিতে ২ বাংলাদেশি আহত Post Views: ৪২৫ SHARES সারা বাংলা বিষয়: