রাখবেন মাটির পাতিল, খোড়া, কাসা, চালুন, ব্যাংক, কলসি, ফুলদানি, পশু-পাখি সানকি…….

প্রকাশিত: ৪:১৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০

স্টাফ রিপোর্টার (জামালপুর) ॥ রাখবেন মাটির পাতিল, খোড়া, কাসা, চালুন, ব্যাংক, কলসি, ফুলদানি, পশু-পাখি, সানকি…..। এভাবেই প্রতিদিন গ্রামের মেঠো পথ ধরে মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপাত বিক্রি করতে হাক ছাড়েন বিলুপ্তপ্রায় গ্রামের ফেরিওয়ালা।
নাম গৌর চন্দ্র। বয়স (৬০) বছরের উপরে। গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ির পিংনা ইউনিয়নের বাড়ইপটল পালপাড়া গ্রামে। শুধু গৌর চন্দ্রই নয়ই- এখানে আদিকাল থেকেই কুমারদের বসবাস রয়েছে। সে সুবাদে কুমারপাড়া নামে একটি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে। বয়সের ভারে নুব্জু বাপ-দাদার পেশা ছিলো মাটির তৈরি হাড়ি-পাতিল তৈরি করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করা। আগের দিনে চিড়াধানের বিনিময়ে এসব জিনিস বিক্রি করা হতো। আধুনিকতার ছোয়ায় আজ হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি বাসন-কোসনের চাহিদা। তারপরও পুর্বপুরুষদের পেশা ছাড়তে পারেনি আজো। কেউ কেউ দুর্মূল্যের বাজারে এ পেশা পরিবর্তন করলে অর্থহীনতার অভাবে আজো জীবন নামের সংসারের ঘানি টানছে দু-চারজন।
গৌর চন্দ্রের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাটির তৈরি জিনিসপত্র গ্রামের মানুষের কাছে তেমন কোন চাহিদা না থাকায় খেয়ে না খেযে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন গাড়ি চলছে ধিক ধিক করে। তিন মেয়ে এক ছেলের সংসারে অনেক কষ্টে দিন তাদের। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। ঘরে রয়েছে বিবাহ যোগ্য আরো ২টি মেয়ে। জাতিগত পেশা ছাড়তে ও পারছে না। অন্য কোন কাজও করার সামধ্য নেই । তাই বাধ্য হয়েই পরিবারের সবাই মিলে সামান্য কিছু জিনিস পত্র তৈরি করে ঝাঁকা মাথায় নিয়ে গ্রামের মেঠো পথে হাক ছেড়ে ডাক তুলছেন- ‘নিবেন মাটির পাতিল, খোড়া, কাসা, চালুন, মাটির ব্যাংক, কলসি, ফুলদানি, পশু-পাখি সানকি’। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া গৌর চন্দ্র এখন আর বেশি সময় চলতে পারেনা।
আজ বিক্রয় কেমন হয়েছে জানতে চাইলে ভারাক্রান্ত মনে বাকরুদ্র কন্ঠে জানান, প্রভু আমার ভাগ্যে যাহা দিয়েছে তাতেই আমি খুশি’। প্রতিদিন বিক্রি করতে না হলে পরিবার নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয় বলেও জানালেন আবেগ জড়িত কণ্ঠে।
সরকার থেকে কোন সুবিধা পেয়েছেন কিনা বললে জানান, মাঝে মধ্যে কিছু কিছু অনুদান পেয়েছি। কিন্তু স্থায়ী কোন সুবিধা পাইনি। জীবন সংগ্রামে আমি এক পরাজিত সৈনিক।
একই গ্রামের সুনীল পাল জানান, বাপ-দাদার চৌদ্দ পুরুষের পেশা ছিলো মাটির হাড়ি পাতিল তৈরি করা। তাদের বাড়িকে লোকেরা কুমারবাড়ি বলেই ডাকে। এছাড়াও পালপাড়া বলে আজো সমাজে পরিচিত। আগের দিনে নৌকাযোগে দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করতেন মাটির তৈরি তৈজসপত্র। একককালে এ জিনিসপত্রের চাহিদা ছিল অনেক। কালের পরিক্রমায় আজ বলতে গেলে তা শূন্যের কোটায়। চাহিদা কমে যাওয়ায় এ পেশায় আজ টিকে থাকাই দায় হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন এ পেশা হারিয়েই যাবে।
রাখাল চন্দ্র পাল বলেন, আগের দিনে ট্রেন ঝাঁকা (বাঁশের তৈরি মাটির পাত্র নেয়ার খাঁচা) ভরে সরিষাবাড়ি নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে মাটির তৈরি জিনিস বিক্রি করে আবার ট্রেন দিয়ে বাড়ি চলে আসতাম। এখন আর কেউ মাটির তৈরি জিসিন নিতে চায়।
পিংনা গ্রামের কবি কামাল হোসেন মুসা জানান, বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ পেশার শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে এখনই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। দেশে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করে মাটির জিনিস পত্রের প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে জনসাধারণকে প্রদর্শন করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্টদের সরকারিভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা। তা না হলে এ মৃৎশিল্প ইতিহাসে পরিণত হবে।
পিংনা ইউপি চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন জয় বলেন, কুমারপাড়া গ্রামে সেই আদিকাল থেকেই বংশপরম্পরা বসবাস করে আসছে। আধুনিক যুগে তাদের এ পেশা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা আজো রয়েছে। সরকারের স্থায়ী পদক্ষেপই রক্ষা করতে পারে মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য।
আবহামানকাল থেকে চলে আসা এ কারুশিল্পী কুমারদের জীবনে এখন রীতিমতো চলছে ভাঙনের খেলা। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আর প্রযুক্তির উন্নয়নের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে আমাদের মৃৎশিল্পীরা আজ তাদের পেশাগত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। জামালপুর জেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য মৃৎশিল্পী ও তাদের পরিবার পূর্বপুরুষের পেশার মর্যাদাকে ধরে রাখতে আজো সংগ্রাম করে যাচ্ছে।