শান্তির দূত বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক পাওয়ার ৫০ বছর ও নতুন বাংলাদেশ : মো. কামরুজ্জামান অনলাইন ডেস্ক অনলাইন ডেস্ক প্রকাশিত: ৬:০২ অপরাহ্ণ, মে ২৮, ২০২৩ ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে’—জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্রেফ কথার কথা হিসেবে এই বক্তব্য দেননি, তা তিনি কৈশোর থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রমাণ করে গেছেন। আজীবন তিনি শোষিতের পক্ষে কথা বলেছেন। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সমাজ তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে করেছে বাঙালির ‘অবিসংবাদিত নেতা’। দেশের মানুষের এই হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাসিক্ত উপাধি তাঁকে বাঙালি মানসে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছিল। যদিও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই আন্তর্জাতিক বিশ্ব বঙ্গবন্ধুর হিমাদ্রীসদৃশ নেতৃত্বের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে তাঁর খবর নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছিল; তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রাপ্তি বঙ্গবন্ধুকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক পাওয়ার অর্ধ শতাব্দী পূরণ: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূরণ হয়েছে এ মাসেই। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে তিনি এই আন্তর্জাতিক পদক লাভ করেন। অর্থাৎ এই মাসটিকে বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণ বর্ষ বলা যেতে পারে। যারা এই পদক পেয়েছেন: এক সময়, বিশেষ করে সোভিয়েত আমলে ‘জুলিও কুরি’ পদককে বিশ্ব শান্তির জন্য সর্বোচ্চ পদক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, চিলির নেতা সালভাদর আয়েন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, চিলির কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, মার্কিন অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো বিশ্ববরেণ্য নেতারা এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যে কারণে এই পদক দেওয়া হয়: মূলত, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা এবং মানবতার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, বিশ্বশান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁদের শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়ে আসছিল ১৯৫০ সাল থেকে। যাঁর নামে এই পদক: ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৫৯ সাল থেকে এই পদকের নাম রাখে ‘জুলিও কুরি পদক’। এর ১৩ বছর পর বঙ্গবন্ধু এই পদকে ভূষিত হন। বঙ্গবন্ধু যে কারণে ও যেভাবে পদকটি পেলেন: দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করার কাজে ডুবে যান। ওই সময় বিশ্ব মিডিয়ায় তাঁর বিষয়ে প্রবল আগ্রহ থাকায় তিনি আন্তর্জাতিক মনযোগের বলা যায় কেন্দ্রে ছিলেন। এমন প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্বশান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধির সবাই সেই প্রস্তাব সমর্থন করেন। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্বশান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশচন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক পরিয়ে দেন। এই পদক ছিল জাতির পিতার কর্ম ও প্রজ্ঞার সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সেই অনুষ্ঠানে রমেশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু।’ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’ বিশ্বশান্তিতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা: বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের উত্থান আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে বিশ্ব পরাশক্তির একাংশের যে অমানবিক অবস্থান, তার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষভাবে আগ্রাসীনীতির অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা, তথা অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে আজ এক সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’ বিশ্বশান্তির বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ কৈশোর থেকেই। রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে তিনি এ বিষয়ে আরও বেশি আত্মনিয়োগ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি একটানা অনেক দিন কারাভোগ করে অবশেষে অসুস্থ অবস্তায় ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। সে বছরই অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত হয় ‘পিস কনফারেন্স অব দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’। তাতে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। এই সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি ৩৭টি দেশ থেকে আগত শান্তিকামী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলেন। সে অভিজ্ঞতার কথা তিনি ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইয়ে বিশদে লিখেছেন। ১৯৫৬ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল স্টকহোমে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। শান্তি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বশান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে শান্তির মসৃণ আগমন দেখেননি। স্বদেশে তিনি পাকিস্তানিদের কাছে বাঙালিদের নিগৃহীত হতে দেখেছেন। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের উত্থান আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত চলছিল, তাও তিনি দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু এই দুটোরই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে বিশ্ব পরাশক্তির একাংশের যে অমানবিক অবস্থান, তার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষভাবে আগ্রাসীনীতির অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা, তথা অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে আজ এক সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’ স্বাধীনতার পর তিনি প্রথমে জোর দিয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ওপর। বিশ্বরাজনীতিতে তখন প্রত্যক্ষ দুটো ব্লক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনায়। তা ছাড়া ছিল সামরিক জোটও। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি।’ একই নীতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা: জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর শান্তিবাদী নীতির আলোকেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশকে যাতে পরাশক্তিগুলোর ক্রীড়ানক হিসেবে ব্যবহৃত হতে না হয়, সে কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছেন। এ বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বকে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, কোনো যুদ্ধকে বাংলাদেশ সমর্থন করে না। তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরনার্থীকে যেভাবে আশ্রয় দিয়েছেন তা তাঁর বৈশ্বিক মাপের শান্তিবাদী নেত্রীর গুনাবলীকে তুলে ধরেছে। শান্তির দুত জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাঁর কন্যা বাস্তবায়িত করে যাচ্ছেন। এ আমাদের জন্য মহা গৌরবের কথা। লেখক : পুলিশ সুপার, শেরপুর। Related posts:সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম, সাধারণ সম্পাদক নঈম নিজামকোমলপানীয়র সঙ্গে নেশাদ্রব্য খাইয়ে কিশোরীকে ধর্ষণপ্রাথমিক শিক্ষা আধুনিকায়নে চিন্তা-ভাবনা Post Views: ৩৬৪ SHARES সম্পাদকীয় বিষয়: