‘হেড স্যার আমার জীবনডা শেষ করে দিল’

প্রকাশিত: ৪:১১ অপরাহ্ণ, মে ৩, ২০২৩

চলতি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল মো. শামীম মিয়ার। কিন্তু ফরম ফিলাপের কিছু টাকা বকেয়া থাকায় পরীক্ষার আগে প্রবেশপত্র আনতে গেলেও তা দেননি প্রধান শিক্ষক। পরে প্রধান শিক্ষক এই শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে যেতে বলেন এবং পরীক্ষার শুরুর আগে কেন্দ্রে গিয়ে তাকে প্রবেশপত্র দেওয়া হবে বলেও জানান। তার কথামতো প্রথম দিনের বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে যায় শামীম, কিন্তু কেন্দ্রে গিয়ে প্রধান শিক্ষককের দেখা পায়নি সে। এমনকি তার স্কুলের কোনো শিক্ষককেই খুঁজে পায়নি। ফলে পরীক্ষার হলেও বসা হয়নি তার। পরীক্ষা দিতে না পেরে প্রধান শিক্ষকের উপর আক্ষেপ ঝাড়ল এই পরীক্ষার্থী- ‘হেড স্যার আমার জীবনডা শেষ করে দিল’।
শামীমের বাড়ি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার জুলগাঁও গ্রামে। উপজেলার ঘাগড়া দক্ষিণপাড়া ফজলুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের চলতি এসএসসি পরীক্ষার্থী সে। কৃষক পরিবারের এই সন্তানের বাবা আব্বাস আলী মারা গেছেন।

বিষয়টি মৌখিকভাবে জানতে পেরে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আল মাসুদ।
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীর জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তর। এই ধাপ পেরিয়েই একজন শিক্ষার্থীকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যেতে হয়; যা পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষার পথ দেখায় তাদের। কিন্তু কোমলমতি কোনো শিক্ষার্থী যদি গুরুত্বপূর্ণ এই ধাপে কোনো কারণে হোঁচট খায় তাহলে তার হতাশ হওয়ারই কথা, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ারই কথা।
শামীম মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলে, ‘আমার বাবা নাই। খুব কষ্ট করে টাকা-পয়সা জোগাড় করে পড়ালেখা চালিয়ে আসছি। অনটনের কারণে এক হাজার টাকা ফরম ফিলাপের সময় কম দিছিলাম। কিন্তু স্যার কম নিতে রাজি হয়নি। স্যারকে বারবার অনুরোধ করেছি, বাকি টাকাটা পরে দিয়ে দিব।
‘এরপর সময়মতো অ্যাডমিট কার্ড নিতে গেছি। স্যার ওই দিন বলছে, টাকা আনসস? আমি স্যারকে বলেছি, স্যার টাকাটা জোগাড় করতে পারিনি। তবে আমি স্যার টাকাটা পরে দিয়ে দিব। তখন স্যার বলল, তুই পরীক্ষা দিবার যাইস তখন অ্যাডমিট দিমুনি। কিন্তু পরীক্ষা দিতে যাইয়া দেখি স্যার আসে নাই। এমনকি আমাদের স্কুলের কোনো স্যারকেই খুঁজে পাইনি।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে শামীম বলে, ‘অ্যাডমিট না পাওয়ায় আমার পরীক্ষায় বসার স্বপ্ন পুড়ে গেল। হেড স্যার আমার জীবনডা শেষ করে দিল।’
ফরম ফিলাপের বকেয়া টাকার বিষয়ে শামীমের মামা আজাদ মিয়া বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম ফিলাপের জন্য তিন হাজার টাকা করে নেন প্রধান শিক্ষক নুরুল হক। তখন শামীম দুই হাজার টাকা দিয়েছিল। সে পরে আরও এক হাজার টাকা দিতেও চেয়েছিল।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষার আগে সব পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র‍ দিয়ে দিলেও মাত্র এক হাজার টাকার জন্য শামীমের প্রবেশপত্র‍ দেননি প্রধান শিক্ষক। এতে শামীমের ১০ বছরের স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল। এমন শিক্ষকদের জন্য একজন ছাত্রের ভবিষ্যৎ খুইয়ে যাবে, এর বিচার চাই।’
এ ঘটনার বিচার চেয়ে শামীমের মা শিরিনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছে। আমি অনেক কষ্ট করে ভাইয়ের বাড়িতে থেকে পোলাডারে পড়াইতাছিলাম। কিন্তু স্যার আমার পোলাডার সর্বনাশ করে দিছে। আমি ওই শিক্ষকের বিচার চাই।’
এ বিষয়ে জানতে ঘাগড়া দক্ষিণপাড়া ফজলুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল হকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মুঠোফোনটিও বন্ধ।
মালিঝিকান্দা ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, ‘শামীম নামের ছেলেটার ফরম ফিলাপ বা প্রবেশপত্র পাওয়ার বিষয়টা আমাকে কেউ জানায়নি। আমি বিষয়টা জানলে পরিষদ বা ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করতাম। এ ঘটনাটি যদি প্রধান শিক্ষক করে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর দাবি জানাই।’
বিষয়টিকে মর্মান্তিক উল্লেখ করে এর উপযুক্ত বিচার চেয়েছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শেরপুর জেলা শাখার সভাপতি মেরাজ উদ্দিন। বলেন, ‘কেবল টাকার জন্য যদি পরীক্ষার হলে বসতে না পারে, তাহলে প্রধান শিক্ষকের এমন কাণ্ডে সচেতন সবাই বিব্রত। এমন দরিদ্র ও এতিম শিক্ষার্থীর শিক্ষার ব্যয়ভার প্রতিষ্ঠান থেকেই চালিয়ে নিতে পারে। ওই শিক্ষকের উপযুক্ত বিচার চাই।’
জানতে চাইলে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আল মাসুদ বলেন, ‘আমাকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানানোর পরে ভুক্তভোগীর পরিবারকে উপজেলায় এসে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখনো তারা কোনো অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রেজুয়ান আহম্মেদ বলেন, ‘বিষয়টি জেনে আমি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে খোঁজ নিতে বলেছি।’