শেরপুরে গ্রামীণ নারীদের আলোর পথ দেখাচ্ছে ‘তথ্য আপা’

প্রকাশিত: ১০:০৫ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০২১

স্টাফ রিপোর্টার : তথ্যপ্রযুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে সমাজে জেন্ডার বৈষম্যের অন্তরায় দূর করতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি অনন্য উদ্যোগ ‘তথ্য আপা’ প্রকল্প। আর শেরপুরে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে লাখো গ্রামীণ নারী স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বাল্যবিবাহ, ফতোয়া, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, চাকরি সংক্রান্ত তথ্য, আইনগত সমস্যাসহ ডিজিটাল নানা সেবা নিয়ে আলোর পথ দেখছেন। শুধু তাই নয়, করোনাকালীন দূঃসময়ে দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার কঠিন কাজটিও করছেন ওই প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মীরা। ফলে ওই প্রকল্পটি ইতোমধ্যে ডিজিটাল সেবার প্রতিচ্ছবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
শেরপুর জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থা কার্যালয়, তথ্য আপা প্রকল্প কার্যালয় ও অন্যান্য একাধিক সূত্র জানায়, ‘শেখ হাসিনার বার্তা নারী-পুরুষ সমতা’ ‘নারী-পুরুষ সমতায় তথ্য আপা পথ দেখায়’ এ স্লোগানকে ধারণ করে ডিজিটাল দেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পটি (২য় পর্যায়) শেরপুর সদর উপজেলাসহ নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নকলায় চলমান রয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জাতীয় মহিলা সংস্থা। প্রকল্পটির মাধ্যমে একযোগে ৮টি বিভাগের ৬৪ জেলার ৪৯০টি উপজেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ওইসব উপজেলার প্রত্যেকটিতে প্রকল্পের আওতায় একটি করে তথ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিটি তথ্যকেন্দ্রে একজন তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও দুইজন তথ্যসেবা সহকারী তথ্য সেবা প্রদানের কাজে নিয়োজিত আছেন। এরাই প্রকল্প এলাকায় ‘তথ্য আপা’ হিসাবে পরিচিত।
এছাড়া, সরকার গৃহীত রূপকল্প-২০২১, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রায় নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। দেশের গ্রামের অসহায়, দরিদ্র, সুবিধাবি ত কিংবা কম সুবিধাপ্রাপ্ত নারীর তথ্যে প্রবেশাধিকার ও তাদেরকে তথ্য প্রযুক্তির সেবা প্রদানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করেছে। এ লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ডিজিটাল দেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন শীর্ষক প্রকল্পটি গৃহীত হয়। প্রকল্পটি ১ম পর্যায়ে ১৩টি উপজেলায় সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তথ্য প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ৪৯০টি উপজেলায় তৃণমূল নারীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে পাঁচ বছর মেয়াদী (এপ্রিল ২০১৭ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত) ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পটি বাস্তবায় করা হচ্ছে। প্রকল্পের মোট জনবল ১৯৭৮ জন। ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে ১৮ জন এবং ৪৯০টি তথ্যকেন্দ্রে ১৯৬০ জন কর্মরত আছেন। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪৪ কোটি ৯০ লক্ষ ৭৪ হাজার টাকা।
সরেজমিনে গেলে কথা হয়, সদর উপজেলার জঙ্গলদী গ্রামের উপকারভোগী রৌশনারা, কুমরী কাটাজান গ্রামের পারভীন ও চান্দেরনগর গ্রামের মনোহার বলেন, তথ্যকেন্দ্রে কর্মরত তথ্য আপারা উঠান বৈঠকে উপস্থিত গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেটের বাস্তব ব্যবহারের মাধ্যমে সেবাপ্রাপ্তির পদ্ধতি প্রদর্শন করেন। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কষি কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, সরকারি আইটি বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন বিষয়ে রিসোর্স পার্সন হিসেবে উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মুক্ত আলোচনা করেন।
নালিতাবাড়ীর গোজাকুড়া গ্রামের রিতা আক্তার, পূর্ব কাপাশিয়া গ্রামের সালমা বেগম ও গোল্লারপাড় গ্রামের ইরানী বেগম বলেন, প্রতিটি উঠান বৈঠকে ১০০ জন নারী অংশগ্রহণ করেন। মাসে প্রতিটি তথ্যকেন্দ্রে ২টি করে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বাল্যবিবাহ, ফতোয়া, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, চাকরি সংক্রান্ত তথ্য, আইনগত সমস্যা এবং বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ই-মেইলে তথ্য আদান প্রদান, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া সম্পর্কিত সেবা দিয়ে লাখো নারীকে আলোর পথ দেখাচ্ছে ‘তথ্য আপা’রা।
তথ্য আপা কেন্দ্রের সদর উপজেলা শাখার কর্মকর্তা সেতু রানী সূত্রধর বলেন, তথ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা, ওজন পরিমাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষাসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। অত্যন্ত সহজ পন্থায় বলতে গেলে ওইসব সেবার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করে নারীর ভাগ্যবদলের দিকনির্দেশনা রয়েছে ‘তথ্যআপা’ উদ্যোগে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকারি নির্দেশনায় অফিস বন্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিকনির্দেশনা মোতাবেক সেবা প্রদান আবারো শুরু হবে।
জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা কর্মকর্তা আসলাম উদ্দীন বলেন, মাইন্ড ইন্সপ্যায়ার টু ন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট ও সেলফ হেল্প গ্রুপের সদস্যদেরকে টেক্সটুয়াল, অডিও, ভিডিও কনটেন্টের মাধ্যমে ই-লার্নিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ফলে গ্রামীণ নারীদের আইটিইএস দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। ই-লার্নিং সিস্টেমে লাইভ ক্লাস, লাইভ ব্রডকাস্ট বক্তৃতা, পূর্ব নির্ধারিত অনলাইন শ্রেণিকক্ষ, ২৪ ঘণ্টা ই-লার্নিং চ্যানেল, ভিডিও গ্যালারী, মোবাইল টিভি, লাইভ স্ট্রিমিং ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকছে। মোট কথা তথ্য আপা প্রকল্প একটি ডিজিটাল প্রতিচ্ছবি। জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা চেয়ারম্যান নাসরিন বেগম ফাতেমা বলেন, প্রতিটি তথ্য কেন্দ্রে নিয়োজিত তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও তথ্যসেবা সহকারীগণ সংশ্লিষ্ট উপজেলার গ্রামীণ নারীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ল্যাপটপ ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, ব্যবসা, জেন্ডার এবং কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করছেন। এছাড়া স্কাইপের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং উপজেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে সেবাগ্রহীতার কথোপকথনের মাধ্যমে সমস্যার দ্রুত ও কার্যকরী সমাধানে সহায়তা করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, গ্রামীণ ও উপশহরাঞ্চলের নারীরাই তথ্যভাণ্ডারের প্রধান সুবিধাভোগী। তবে তথ্যভান্ডারের সেবাগ্রহীতা হতে পারেন শিক্ষাবিদ, গবেষক, নীতিনির্ধারক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ।
জেলা মহিলা ও শিশু বিষয়ক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক লুৎফুল কবির বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতো তথ্য আপা প্রকল্পটি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এটি বাস্তবায়নে জেলার ৫ উপজেলার ইউএনও সাহেবরা প্রত্যক্ষভাবে তদারকি করছেন। আর এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজ আল মামুন জানান, প্রকল্প অফিস ও মাঠ পর্যায়ে সভা, অনুষ্ঠান আয়োজনের তথ্য সংরক্ষণ, উপকারভোগীদের তালিকা সংরক্ষণ, তাদেরকে সেবা প্রদান, সেবা প্রদানকালে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা হচ্ছে।