প্রাথমিক শিক্ষা আধুনিকায়নে চিন্তা-ভাবনা

প্রকাশিত: ৬:৫৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩

সামাজিক জীবনে নৈতিকতা, মানবিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা ও সামাজিক মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করার মূল হাতিয়ার হলো শিক্ষা। আর গুণগত ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা হলো পরবর্তী শিক্ষার মূল ভিত।

ইংরেজ কবি জন মিল্টন বলেছেন, ‘Education is the harmonous development of mind, body and soul’ মানুষ শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত নতুন জ্ঞান, দক্ষতা ও নবতর দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে নিজের ও পারিবারিক জীবনকে আরও সুন্দর, অর্থবহ করার পাশাপাশি সমাজ ও দেশের জন্য অবদান রাখতে সক্ষম। আর এই শিক্ষাদানের বিষয়টি শুরু হয় পরিবার থেকেই। শিশুর শিক্ষার মূল বুনিয়াদ গড়ে ওঠে পারিবারিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গমন করে।

অন্যদিকে বলা যায়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না এমন বাক্য ছোট বেলা থেকেই আমরা বুঝে বা না বুঝেই মুখস্থ করে এসেছি। এছাড়া এগুলো অতিশয় সত্য বাণীও বটে। আর এ মেরুদণ্ড যে স্থানে তৈরী হয় তার নাম প্রাথমিক বিদ্যালয়। উন্নত জাতি গঠন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রাাথমিক শিক্ষার গুত্বত্ব সর্বাধিক। বলা যায়, একটি শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও মানবিক গুণসম্পন্ন আদর্শবান মানুষ হিসেবে তৈরীর পেছনে এবং সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বীজ হলো প্রাথমিক শিক্ষা।
তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষককে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন প্রদানের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ ও প্রাথমিক শিক্ষকদের দুঃখ-দুদর্শা লাঘবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি চিন্তা করে আজও আমরা বিস্মিত হই।

১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়করণের পদক্ষেপকে ধ্বংসের জন্য ঢাকা মহানগরীর প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা পৌরসভা ও সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় গ্রাম সরকারের কাছে ন্যস্ত করে জাতীয় সংসদে দুটি আইন পাস করা হয়। পরবর্তীতে ওই বছরেই ঢাকা মহানগরীতে ২৭ দিন এবং ১৯৮১ সালে দেশব্যাপী ৩ মাস ১০ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। এতে আইন ২টি বাতিল করা হয়।

এক যুগ আগেও বাংলাদেশে বিদ্যালয়গামী ছাত্র-ছাত্রীর হার ছিল খুব কম এবং মেয়েদের হার ছিল আরও কম। ২০০৯ সাল থেকে বছরের পহেলা দিন প্রাক-প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বিভিন্ন রঙের বই প্রদান কার্যক্রম চাল করেন বর্তমান সরকার। এর আগে কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি ও মাদ্রাসায় বিনামূল্যে বই দেয়া হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও তিনি উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ জাতীয়করণ করে চলেছেন। ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শেণির মর্যাদা প্রদান করা হয়।

বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯-এর প্রকোপে অন্য সব খাতের সঙ্গে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা গভীর সংকটে পড়ে। প্রায় ১৮ মাস পর ২০২১ সালে ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হলেও করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২২ সালে ২১ জানুয়ারি আবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালের ২ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবার খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ এই বন্ধের ফলে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। ২০২১ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফ ও ইউনেসকোর এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে।

এরপরেও বর্তমান সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ যেমন- সময়মত বই বিতরণ, বিনা বেতনে শিক্ষা, ফ্রি টিফিনের ব্যবস্থা, বাল্য বিবাহ রোধ, শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজনসহ প্রভৃতি কারণে বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষার হারও প্রতি বছর বেড়েই চলেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের সিলেবাসে দেখা যায়, সেখানে নৈতিক শিক্ষা বা নীতি কথার চেয়ে তাত্ত্বিক কথা সিংহভাগ; যা বাচ্চারা মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাশের জন্য। বর্তমান সমাজে ভালো ফলাফল করেছে এমন শিক্ষার্থীর অভাব নেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ভাল মানুষের বড়ই অভাব। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে নৈতিক শিক্ষা চালু, পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, নতুন করে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি, ব্যবস্থাপনা কমিটিতে শিক্ষিত নাগরিত রাখা, অভিভাবক কমিটি গঠনসহ পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি।

এছাড়া জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষকদের নিয়ে মাসিক সমন্বয় সভা, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শন, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য অভিভাবক ও মা সমাবেশের আয়োজন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, মাদক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সভা, শিশু শ্রম বন্ধ করা, বিদ্যালয়ে সততা স্টোর চালু করা, মিড- ডে মেইল চালুসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে এগোতে হবে। বিনয়ী, সৎ ও যোগ্যতা সম্পন্ন একটি জাতি গঠনের জন্য যে সব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো অবশ্যই একদিন দূর হবে এবং যে স্বপ্ন সাধ নিয়ে এই জাতির পথ চলা শুরু হয়েছিল তা অচিরেই পূর্ণ হবে এই প্রত্যাশাই করছি।

লেখক- মো. ফারুক-আল-মাসুদ
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
ঝিনাইগাতী, শেরপুর।
ই-মেইল- uno.jhenaigati2018@gmail.com