ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জনের মৃত্যু

প্রকাশিত: ৩:৩৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০২২

ঈদুল আজহার আগে-পরে সড়ক-মহাসড়কে ৩১৯টি দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত হয়েছেন এবং ৭৭৪ জন আহত হয়েছেন। রেল ও নৌপথ মিলিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন মোট ৪৪০ জন। আর সব মিলিয়ে আহত হয়েছেন ৭৯১ জন। গত ঈদুল আজহার তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা ২৪.৭৬ শতাংশ এবং নিহতের সংখ্যা ৩১.৪১ শতাংশ বেড়েছে।
মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের প্রতিবেদনে উঠে আসা এ তথ্য জানান সমিতির মহাসচিব মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্যরা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক ও অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে দুর্ঘটনার তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, করোনা না থাকার কারণে এবারের ঈদে বেশি মানুষের যাতায়াত হয়। রাজধানী থেকে ১ কোটি ২০ লাখ এবং ৪ কোটি মানুষ আন্তঃজেলায় যাতায়াত করেছে। এছাড়া এবারের ঈদে সবচেয়ে বেশি ভাড়া নৈরাজ্য হয়েছে এবং ৪ ঘণ্টার যাত্রা ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা সময় লেগেছে। ঈদযাত্রায় সড়কে যানজটের সুযোগ লুফেছে হোটেল ব্যবসায়ীরা। তারা নিম্নমানের খাবার বেশি দামে বিক্রি করেছে। পথে পথে যাত্রী হয়রানী ও ভাড়া নৈরাজ্যের পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন বাসের পাশাপাশি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ, মুরগিবাহী প্রিজন ভ্যানেও যাত্রী যাতায়াত করতে দেখা গেছে। বরাবরের মতো ট্রেনে শিডিউল বিপর্যয়, টিকিট কালোবাজারি, টিকিট পেতে বিড়ম্বনাসহ নানা ভোগান্তি রেল যাত্রীদের পিছু লেগেই ছিল। পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে দেশের বিভিন্ন নৌপথে ভাড়া কমানো হলেও ঈদযাত্রায় টিকিট কালোবাজারি, ভাড়া নৈরাজ্য নৌপথের যাত্রীদের আগের মতোই ছিল।
তিনি জানান, সমিতির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ঈদযাত্রা শুরুর দিন ৩ জুলাই থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ১৭ জুলাই পর্যন্ত ১৫ দিনে ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত এবং ৭৭৪ জন আহত হয়েছেন। রেলপথে ২৫টি দুর্ঘটনায় ২৫ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়েছেন। নৌ-পথে ১০টি দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছেন এবং ৩ জন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার তথ্য মিলেছে। বিগত ৭ বছরের তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটোই সর্বোচ্চ।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে ছিল মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১১৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩১ জন নিহত এবং ৬৮ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫.৪২ শতাংশ, নিহতের ৩২.৯১ শতাংশ। তবে মোটরসাইকেল বন্ধ করায় ৯ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে।
এই সময়ে সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারান ১৫৭ জন চালক, ৮ জন পরিবহন শ্রমিক, ১০৬ জন পথচারী, ৬২ জন নারী, ৫১ জন শিশু, ৩৬ জন শিক্ষার্থী, ৬ জন সাংবাদিক, ৪ জন চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৫ জন সদস্য, ৬ জন শিক্ষক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৬ জন নেতাকর্মী এবং ১ জন প্রকৌশলী।
দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ২৯.৩ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২৩.১৮ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ৫.৬২ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৩.৯৮ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ১১.৪৭ শতাংশ অটোরিকশা, ৯.৩৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল ও ১৭.৩৩ শতাংশ বাস এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।
সংঘটিত দুর্ঘটনার ২৩.১৯ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৫০.৭৮ শতাংশ পথচারীকে চাপা, ১৮.৪৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়া, ৬.৮৯ শতাংশ অজ্ঞাত কারণে ও ০.৩১ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩২.৯১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৬.৭০ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৫.৩৬ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪.৭০ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে সংঘটিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সেইফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সর্পোট অ্যালায়েন্স (শ্রোতা) এর সভাপতি ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের ফলেও সড়ক দুর্ঘটনা ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে সড়ক নিরাপত্তাহীনতা অন্যতম একটি মানবিক বিপর্যয়। আমরা বন্যা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে বলি। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে তেমন কিছু করছি না। কিন্তু এর ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে।
অব্যাহত অচলাবস্থা চারটি মূল ঘাটতির কারণে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা, পরিবহন খাতের ভারসাম্যহীন বিস্তার, জনস্বার্থের বিপরীতে গোষ্ঠীর স্বার্থ পরিবহন খাতে এক ধরনের রাজনৈতিক আনুকূল্য পাওয়া এবং নাগরিক উদ্যোগগুলোর ও সার্বিকভাবে একটি গতির ঘাটতি রয়েছে বলেই সড়ক দুর্ঘটনা অব্যাহতভাবেই বাড়ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ডিভাইডারবিহীন রাস্তাগুলোতে হয়েছে। আমাদের চালকদের যে আচরণ তাতে কোনো রাস্তায় আনডিবিডার রাখা যাবে না। এক্ষেত্রে সরকারকে এই উদ্যোগ নিতে হবে। মুখোমুখি সংঘর্ষগুলো এক্ষেত্রে অনেকটাই কমানো যাবে। সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো চালকরা এই ঈদের ৫ দিন কিংবা ১০ দিনে পর্যাপ্ত ঘুমাচ্ছে না। অসচেতনতা কিংবা মালিকদের চাপে অতিরিক্ত পরিমাণ গাড়ি চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে চালকদের রোস্টারিং তালিকা প্রকাশ কিংবা সরকারের কাছে জমা দেওয়া জরুরি সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য।
প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ঈদে যাতায়াতকারী ব্যক্তিগত যানের চালকদের রাতে এসব জাতীয় সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালানো; জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকার ফলে নতুন চালকদের এসব সড়কে দুর্ঘটনায় পড়েছে; মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা; উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন, মোটরসাইকেল, ইজিবাইক ও অটোরিকশার সংখ্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়া।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সমিতির সুপারিশগুলো হলো- জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতে অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা; দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ত্রুটি সারানোর উদ্যোগ গ্রহণ; ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা; সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা; সড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা; সড়ক পরিবহন আইন যথাযতভাবে বাস্তবায়ন করা। এছাড়াও ট্রাফিক আইনের অপপ্রয়োগ রোধ করা; গণপরিবহন বিকশিত করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা দরকার।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।