সবার প্রিয় ছিলেন ডা. সুলতানা পারভীন

প্রকাশিত: ১:৫৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৮, ২০২০

স্টাফ রিপোর্টার, জামালপুর ॥ জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. সুলতানা পারভিনের ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ ভগ্নিপতি আসাদুল হাফিজের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি তার লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি রাজশাহী জেলায় গেছেন। সহকারী পুলিশ সুপার সীমা রানী বিশ^াস বলেন, ডাক্তার সুলতানা পারভীনের মৃত্যু নিয়ে নানাদিক বিচার বিশ্লেষণ করে তদন্ত হচ্ছে। আমাদের প্রাথমিক ধারণা, হতাশাগ্রস্থতা থেকেই আত্মহত্যা করেছেন তিনি। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ভিসেরা রিপোর্ট পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।
ডা. সুলতানা পারভীন গাইনী বিভাগের এ সার্জন ছিলেন সবার প্রিয় ‘ডাক্তার আপা’। এ হাসপাতালে দেড় বছর চাকরি করেই রোগী, রোগীর স্বজন, ডাক্তার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মন জয় করে নিয়েছিলেন কাজের দক্ষতা ও ব্যবহারে। হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের সাথে শিশুরা এলে তাদের সাথেও ভাব জমাতেন খুব সহজেই। সবার মুখে একই কথা, তিনি খুব প্রাণচঞ্চল ও প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। হাসপাতালের করিডোরে প্রাণখোলা হাসিমুখে ঘুরে বেড়াতেন। অথচ হতাশাগ্রস্ততা থেকেই তিনি বেছে নিলেন আত্মহত্যার পথ। এ কথা যেন মানতে পারছেন না তার সহকর্মী ও হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সবাই অবাক হয়েছেন প্যাথেডিন পুশ করা অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার নিয়ে। এর আগে কেউ না পেয়েছেন তার মাদকাসক্ততার কোনো লক্ষণ, না পেয়েছেন ব্যক্তিগত দুঃখবোধের পরিচয়। মা-বাবার ৪ কন্যা সন্তানের মধ্যে সুলতানা সবার বড় ছিলেন। আশপাশের আত্মীয়দের আপদেবিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার এ মৃত্যু যেন কেউ মেনে নিতে পারছে না। তার কর্মস্থলেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, তিনি খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন। গরিব রোগীদের বিনা পয়সায় দেখতেন। আবার নিজ অর্থে ওষুধ কিনে দিতেন।
হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মচারী উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, হাসপাতাল কোয়ার্টারে তার কক্ষের দরজা ভেঙে লাশ উদ্ধারের সময় পাওয়া গেছে একটি চিঠি ও ডায়েরি। ডায়েরিতে সাব্বিরের সাথে প্রেম, বিয়ে, কলহ ও বিচ্ছেদ নিয়ে অনেক কথা লেখা আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। প্রায় ৪ বছর আগে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন তিনি। প্রেমিক স্বামী ছিলেন বুয়েটের ছাত্র। স্বামী সাব্বিরের বাড়ি খুলনা জেলায়। বিয়ের পর তাদের মধ্যে দেখা দেয় দাম্পত্য কলহ। কলহ থাকা অবস্থাতেই সাব্বির কানাডা চলে যান। সেখান থেকেই সাব্বির ডা. সুলতানা পারভীনকে তালাক দেন। সম্প্রতি দেশে ফিরে সাব্বির ফের বিয়ে করেন। প্রেমিক স্বামীর বিয়ের খবর মেনে নিতে পারেননি তিনি। ৫টি প্যাথেডিন শরীরে পুশ করে আত্মহত্যা করেছেন এ মেধাবী ডাক্তার। এমনটাই দাবি হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও উপজেলা পুলিশ প্রশাসনের।
এইসএসসি পর্যন্ত রাজশাহীতেই তার লেখাপড়া। উচ্চ মাধ্যমিকের পর মেধা তালিকায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে রংপুর মেডিকেলে লেখাপড়া করেন তিনি। চার বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। বর্তমানে তার মা-বাবা ও বোনেরা ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ডা. সুলতানা পারভীনের দাদাবাড়ি চট্টগ্রামের সন্দীপ থানার বাউনিয়া এলাকায়। তার পিতা আলাউদ্দিন আজাদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পেশায় ছিলেন রেল পুলিশের ইন্সপেক্টর। চাকরির সুবাদে পিতা রাজশাহী জেলা সদরের পোস্টাল একাডেমি গলি এলাকায় স্থায়ী নিবাস গড়লে সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। তিনি মেলান্দহ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর যোগদান করার আগে ডা. সুলতানা পারভীন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। এখানে যোগদান করার পর একাই থাকতেন হাসপাতাল কোয়ার্টারে। মাঝেমধ্যে তার মা এসে থাকতেন।
ডাক্তার সুলতানা পারভীন শনিবার ১৫ আগস্ট জামালপুর শহরের শাহজামাল হাসপাতালে রোগী দেখে রাতে ডা. সুলতানা পারভীন কোয়ার্টারে ফেরেন। রোববার ১৬ আগস্ট সকালে আয়া ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে তার কক্ষ ভেতর থেকে বন্ধ পান। বিকাল ৩টার সময় শাহজামাল হাসপাতালে তার রোগী দেখার কথা ছিলো। ওই হাসপাতাল থেকে গাড়ি যায় তাকে আনতে। ড্রাইভার দরজায় নক করে এবং অনেক ডাকাডাকির পরও সাড়াশব্দ না পেয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলুল হককে বিষয়টি জানান। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তার পিয়ন পাঠিয়ে দেন ডাক্তার সুলতানা পারভীনকে ডাকতে। পিয়ন ডাকাডাকির পর দরজা না খোলায় ফিরে এসে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে জানান। সন্দেহ হলে মেলান্দহ থানায় বিষয়টি অবহিত করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। পরে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ডা. সুলতানা পারভীনের লাশ উদ্ধার করেন। রাতেই স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলুল হক বাদী হয়ে মেলান্দহ থানায় অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছেন।
মেলান্দহ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. আতাউর রহমান ডা. সুলতানা পারভীনের সাথে অপারেশন থিয়েটারে কাজ করতেন। তিনি জানান, তার মুখে কখনো বিষন্নতার ছায়া দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন সুদক্ষ ও চৌকষ ডাক্তার। তার চিকিৎসায় এ পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তিনি ছিলেন প্রাণচঞ্চল ও প্রাণবন্ত মানুষ। এমন মানুষ এভাবে আত্মহত্যা করবেন, কল্পনাও করা যায় না।
আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. নাজমুল হাসান নবীন জানান, ডা. সুলতানা পারভীন মেন্টাল ডিপ্রেশন থেকেই আত্মহত্যা করতে পারে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। তিনি ডিপ্রেশনে ছিলেন আমরা কখনো বুঝতে পারিনি। ৫টি প্যাথেডিনের এ্যাম্পলসহ তার লাশ উদ্ধারে আমরা অবাক হয়েছি। কারণ আমার কখনো মনে হয়নি তিনি প্যাথেডিন নিতে পারেন।
মেলান্দহ থানার ওসি রেজাউল করিম খানের দাবি পুলিশ নিহত সুলতানা পারভীনের লাশ ময়না তদন্তের জন্য জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করলে সোমবার ১৭ আগস্ট তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে ওই ডাক্তারের লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ডাক্তার সুলতানা পারভীন আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর শরীরে প্যাথেডিন পুশের আলামত পাওয়া গেছে। ৫টি প্যাথেডিন ও একটি সিরিঞ্জ তাঁর বালিশের নিচে পাওয়া গেছে।
মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. ফজলুল হক জানিয়েছেন, লাশ উদ্ধারের সময় তার বিছানা থেকে ৫টি প্যাথেডিনের এ্যাম্পল পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, শরীরে প্যাথেডিন পুশ করেই ডা. সুলতানা পারভীন আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। স্বনামধন্য এ ডাক্তারের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। এ মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনে আইনি তদন্ত চলছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তামিম আল ইয়ামীন জানান, ডাক্তার সুলতানা পারভীনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনে গভীরভাবে তদন্ত চলছে।
জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তার দেহে প্যাথেডিন প্রয়োগের আলামত পাওয়া গেছে। ভিসেরা রিপোর্ট পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।
চিকিৎসক সুলতানা পারভিন রংপুর মেডিকেল কলেজের ৩০তম ব্যাচ ডাক্তারি পাস করেন। পরে ৩২তম বিসিএস দিয়ে ডাক্তার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। তিনি ২০১৮ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তার এ মৃত্যুকে কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে পারছেন না উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরতরা।
উল্লেখ্য, জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টারে নিজ কক্ষ থেকে ডাক্তারের লাশটি বিছানার ওপর পড়ে থাকা অপবস্থায় উদ্ধার করে। রোববার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে কক্ষের দরজা ভেঙে লাশটি উদ্ধার করা হয়। ডাক্তারের নাম সুলতানা পারভীন (৩৭)। তিনি মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টারের ওই কক্ষে তিনি একাই থাকতেন।