কথা বলার আগে ভাবুন

প্রকাশিত: ১:২৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৫, ২০২১

হজরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম

বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, চুপ থাকার অনেক ফজিলত। চুপ থাকলে মেজাজ সংযত থাকে; অন্তরে আল্লাহর ভয়-ভীতি থাকে; জিকির ও ইবাদতের জন্য সময় পাওয়া যায়।

বেশি কথা বলার মাঝে নানা রকম বিপদ। কথা বেশি বলার কারণে ভুল বেশি হয়। মিথ্যা, গিবত, চোগলখুরি, পরনিন্দা, রিয়া (লোক দেখানো), কপটতা, নির্লজ্জতা, কথা-কাটাকাটি, বাড়িয়ে কথা বলা, অপরকে কষ্ট দেওয়া, অন্যের গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়ার মতো বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়। মহান আল্লাহ মানুষকে দু’টো কান আর একটি মুখ দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, মানুষকে বেশি শুনতে হবে। বলতে হবে কম। অনেক মানুষ সবসময় বেশি কথা বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু প্রয়োজনের আলোকে কথা বলা দোষণীয় নয়। মানুষকে তিন অবস্থার যেকোনো এক অবস্থায় জিহবাকে রাখতে হবে। ১. সৎ কাজের আদেশ কিংবা অসৎ কাজের নিষেধ ২. আল্লাহর জিকির ও ৩. চুপ থাকা।

কথা বলা প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে বর্ণিত পরিভাষাসমূহের বিশ্লেষণে এসব বলেছেন তাফসিরকারকরা। কথা প্রসঙ্গে কোরআনে বর্ণিত পরিভাষাগুলো হলো-

সঠিক কথা বলা (কাওলান সাদিদা)
আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে সঠিক কথা বলতে নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তোমাদের কার্যক্রমসমূহ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন। আর যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করে তারা অবশ্যই মহাসফলতা লাভ করবে।’ -সুরা আহজাব : ৭০-৭১

শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলা (কাওলান কারিমা)
আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, ‘তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদের উহ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদেরকে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো।’ -সুরা বনি ইসরাঈল : ২৩

সহজভাবে কথা বলা (কাওলান মায়সুরা)
দয়াময় আল্লাহ বলেন, ‘তোমার পালনকর্তার করুণার প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ থাকাকালে যদি কোনো সময় তাদেরকে বিমুখ করতে হয় তাদের সঙ্গে নম্রভাবে কথা বল।’ -সুরা বনি ইসরাঈল : ২৮

নম্রভাবে কথা বলা (কাওলান লায়্যিনা)
আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা উভয়েই ফেরাউনের কাছে যাও সে উদ্ধত হয়েছে। অতঃপর তোমরা তাকে নম্র কথা বল। হয়ত সে চিন্তা ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে। -সুরা ত্বাহা : ৪৩-৪৪

শরিয়তসম্মত কথা বলা (কাওলান মারুফা)
আর যদি তোমরা আকার ইঙ্গিতে সেই নারীর বিয়ের পয়গাম দাও কিংবা নিজেদের মনে গোপন রাখো, তবে তাতেও তোমাদের কোনো দোষ নাই আল্লাহ জানেন যে, তোমরা অবশ্যই সেই নারীদের কথা উল্লেখ করবে। কিন্তু তাদের সঙ্গে বিয়ে করার গোপন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখো না। অবশ্য শরিয়ত নির্ধারিত প্রথা অনুযায়ী কোনো কথা সাব্যস্ত করে নিবে। -সুরা বাকারা : ২৩৫

আর যে সম্পদ আল্লাহতায়ালা তোমাদের জীবনযাত্রার অবলম্বন করেছেন তা অর্বাচীনদের হাতে তুলে দিও না। বরং তা থেকে তাদেরকে খাওয়াও পরাও এবং তাদেরকে সান্ত্বনার বাণী শোনাও। -সুরা নিসা : ৫

খোঁটা দিয়ে কথা না বলা
অন্যত্র বলেন, এবং সম্পত্তি বণ্টনের সময় আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও মিসকিন উপস্থিত হয় তখন তা থেকে তাদের কিছুই খাইয়ে দাও এবং তাদের সঙ্গে কিছু সদালাপ করো।’ -সুরা নিসা : ৮

উপদেশপূর্ণ কল্যাণকর কথা বলা (কাওলান বালিগা)
তারা হলো, সেই সমস্ত লোক যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কেও আল্লাহতায়ালা অবগত। অতএব আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোনো কথা বলুন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। -সুরা আন নিসা : ৬৩

গুরুতর কথা (কাওলান আজিমা)
তোমাদের পালনকর্তা কি তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান নির্ধারিত করেছেন এবং নিজের জন্য ফেরেশতাদেরকে কন্যারূপে গ্রহণ করেছেন। নিশ্চয়ই তোমরা গুরুতর গর্হিত কথা বলছ। -সুরা বনি ইসরাঈল : ৪০

গুরুত্বপূর্ণ বাণী (কাওলান সাকিলা)
আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। -সুরা মুজ্জাম্মিল : ৫

এই আয়াতে ভারী কালাম বলে কোরআনে কারিমকে বুঝানো হয়েছে। কেননা কোরআনে কারিমে বর্ণিত হালাল-হারাম, জায়েজ-নাজায়েজের সীমা স্থায়ীভাবে মেনে চলা স্বাভাবিকভাবে ভারী ও কঠিন। তবে যার জন্য আল্লাহতায়ালা সহজ করে দেন তার কথা স্বতন্ত্র। কোরআনকে ভারী বলার আরেক কারণ এই যে, কোরআন নাজিল হওয়ার সময় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ ওজন অনুভব করতেন ফলে প্রচন্ড শীতেও তার মস্তক ঘর্মাক্ত হয়ে যেতো। তিনি তখন কোনো উটের উপর সওয়ার থাকলে বোঝার কারণে উট নুয়ে পড়ত। -সহিহ বোখারি
কোরআনে কারিমে কথা বলার কতিপয় নির্দেশনা
-কথাবার্তায় কর্কশ না হওয়া। -সুরা আলে ইমরান : ১৫৯
-লোকদের সঙ্গে ধীরস্থিরভাবে শান্তভাবে কথা বলা। -সুরা ত্বোয়া-হা : ৪৪
-উচ্চস্বরে কথা না বলা। -সুরা লোকমান : ১৯
-অন্যকে নিয়ে উপহাস না করা। -সুরা হুজরাত : ১১
-পিতা-মাতার প্রতি সম্মানজনক কথা বলা। -সুরা বনী ঈসরাইল : ২৩
-সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত না করা। -সুরা আল বাকারা : ৪২
-খোঁটা দিয়ে কথা না বলা। -সুরা আল বাকারা : ২৬৪
-গালাগাল না করা। -সুরা আল বাকারা : ৬০
-বিভক্তি না উসকানো। -সুরা আলে ইমরান : ১০৩
-প্রতারণার পক্ষে ওকালতি না করা। -সুরা আন নিসা : ১০৫
-মানুষকে আল্লাহর পথে হিকমা ও উত্তমভাবে ডাকা। -সুরা আন নাহল : ১২৫